নড়াইল জেলার সাতদোহা গ্রামে নবগঙ্গা নদীর তীরে অবস্থিত শ্রী শ্রী ন্যাংটা বাবার আশ্রম ভক্ত-অনুরাগীদের কাছে এক অনন্য সাধনাস্থল হিসেবে পরিচিত। প্রতিবছর এখানে হাজারো মানুষ সমবেত হন তার সমাধিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে এবং ধর্মীয় অনুষ্ঠানে অংশ নিতে।
ন্যাংটা বাবার জন্ম ১৯২৫ সালে নড়াইল জেলার ভবানীপুর গ্রামে। তিনি বারেন্দ্র শ্রেণীর ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা শ্রী বেণীমাধব চক্রবর্তী এবং মাতা পূর্ণ সুন্দরী দেবী। জন্মের পর থেকেই শিশুটির মধ্যে অলৌকিক লক্ষণ প্রকাশ পেতে থাকে। বিশ্বাস করা হয়, তার জন্মের পর পরিবারে আয়ের উন্নতি ও সৌভাগ্য বৃদ্ধি পায়। এমনকি একবার ভবানীপুরে কলেরার প্রাদুর্ভাব হলে গ্রামবাসীরা তার আশীর্বাদ চান। তিনি জল পড়া ছিটিয়ে দিলে সেই মহামারি থেমে যায় বলে প্রচলিত রয়েছে।
মাত্র বারো বছর বয়সে তিনি সংসার ত্যাগ করেন এবং আধ্যাত্মিক সাধনায় মনোনিবেশ করেন। প্রথমে মাগুরা জেলার সাধুহাটি গ্রামে দীর্ঘ ধ্যানমগ্ন অবস্থায় সময় কাটান। সেখানেও ভক্তদের ভিড় জমতে থাকে। পরবর্তীতে ধ্যানকালে তিনি বসুদেবের দর্শন পান। এরপর নবগঙ্গা নদীতে ধ্যানরত অবস্থায় তিনি হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে যান। পরে স্থানীয় জেলেরা তাকে উদ্ধার করেন এবং তাকে উলঙ্গ অবস্থায় দেখে চমকে ওঠেন। কোনো পোশাক তার শরীরে থাকেনি, সেখান থেকেই তিনি “ন্যাংটা বাবা” নামে পরিচিতি পান।
ঐতিহাসিক সাতদোহা মহাশ্মশানের পাশে গড়ে ওঠে তার আশ্রম। জনশ্রুতি রয়েছে, ব্রিটিশ আমলে এখানে ছিল নীলকুঠি এবং নীলচাষ হতো। ইংরেজরা চলে যাওয়ার পর এ এলাকা পরিণত হয় জঙ্গলে। পরে স্থানীয় ফটিক চন্দ্র বিশ্বাস নিজের জমি দান করে জঙ্গল পরিষ্কার করে আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন। বর্তমানে এখানে ন্যাংটা বাবার সমাধি মন্দির, নাটমন্দির এবং অন্যান্য সাধকদের কয়েকটি সমাধি রয়েছে।
ন্যাংটা বাবার জীবনে অসংখ্য অলৌকিক ঘটনার বর্ণনা পাওয়া যায়। বলা হয়, একবার নামযজ্ঞের সময় তিনি তার শিষ্যকে মাত্র এক সের চাল ও এক পোয়া ডাল রান্না করতে বলেন। শিষ্য সনাতন তা গোপনে এক ক্ষুধার্ত ব্রাহ্মণকে খেতে দিলে ন্যাংটা বাবা রুষ্ট হন। পরে তিনি অবশিষ্ট প্রসাদ তিনটি কুকুরকে খেতে দেন এবং সনাতনকে স্পর্শ করে দেখান—সেই কুকুর আসলে ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বর। এই ঘটনার পর থেকেই তার অলৌকিক ক্ষমতার কথা আরও ছড়িয়ে পড়ে।
তার নির্দেশনা অনুসারে প্রতিবছর মাঘী পূর্ণিমায় ৭২ ঘণ্টার নামযজ্ঞ অনুষ্ঠিত হয়। নবগঙ্গা নদীপথে দূরদূরান্ত থেকে ভক্তরা চাল, ডাল, তেল, লবণ, শাকসবজি নিয়ে আসেন। সেই থেকে এ আশ্রম ধর্মীয় অনুষ্ঠান ও আধ্যাত্মিক চর্চার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে।
বাংলা ১৩৭০ সালের ৩১ বৈশাখ, মঙ্গলবার তিনি আসনে বসা অবস্থায় দেহত্যাগ করেন। তাকে সাতদোহা মহাশ্মশানে সমাহিত করা হয়। আজও সেখানে ভক্তরা ভিড় করেন, শ্রদ্ধাঞ্জলি দেন এবং আশীর্বাদ প্রার্থনা করেন। প্রতিবছর জগন্নাথ দেবের রথযাত্রা উপলক্ষে এখানে মেলা বসে, যেখানে লোকজ সামগ্রীসহ নানা সাংস্কৃতিক আবহ তৈরি হয়
শ্রী শ্রী ন্যাংটা বাবা শুধু একজন সাধকই নন, তিনি ছিলেন আধ্যাত্মিক শক্তির প্রতীক। তার জীবনগাথা ও আশ্রমকে ঘিরে অসংখ্য কাহিনি ও অলৌকিক ঘটনার বর্ণনা স্থানীয় জনগণ আজও লালন করেন। নবগঙ্গা তীরের সাতদোহা আশ্রম তাই ভক্তদের কাছে শুধু একটি ধর্মীয় স্থান নয়, বরং বিশ্বাস ও ভক্তির কেন্দ্রবিন্দু হয়ে আছে।