খাগড়াছড়ি উত্তেজনার নেপথ্যে পরাজিত শক্তি ও শেখ হাসিনার ভূমিকা–আরিফ বিল্লাহ
সম্প্রতি খাগড়াছড়ি অঞ্চলে সৃষ্ট উত্তেজনা কেবল একটি স্থানীয় সংকট নয়, বরং জাতীয় রাজনীতির জটিলতার অংশ হিসেবেই দেখা দিচ্ছে। এর পেছনে যে শক্তিগুলো কাজ করছে, তারা মূলত পরাজিত শক্তি—যারা দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার পর জনগণের আস্থা হারিয়ে আজকে দেশ ও জাতির স্বার্থের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। বিশেষ করে শেখ হাসিনা, যিনি বর্তমানে ভারতে অবস্থান করছেন, তাঁর ভূমিকা এখানে স্পষ্ট হয়ে উঠছে। তিনি বাইরে বসেই বাংলাদেশকে অশান্ত করার এক গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছেন।
আমজনতার দলের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আরিফ বিল্লাহ বলেন, আওয়ামীলীগ সবসময়ই সংকটকে নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করেছে। বর্তমান পরিস্থিতিতেও তারা খাগড়াছড়ির অশান্তিকে ঘুরাজনীতির অংশ করে তুলতে চায়। জনগণের দৃষ্টি ভিন্ন দিকে ঘোরাতে এবং জাতীয় রাজনৈতিক অঙ্গনকে অস্থিতিশীল করতে তারা নানাভাবে উসকানি দিচ্ছে। এতে দেশজুড়ে বিভ্রান্তি ও অনিশ্চয়তার পরিবেশ তৈরি হচ্ছে।
আরও ভয়াবহ হলো ভারতের সঙ্গে আওয়ামী লীগের গোপন আঁতাত। দীর্ঘদিন ধরেই অভিযোগ রয়েছে, আওয়ামী লীগ দেশের সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে আপস করেছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে শেখ হাসিনা ও তাঁর দল ভারতের কাছে বিশেষত চট্টগ্রামের কৌশলগত গুরুত্ববহ এলাকা বিক্রির পরিকল্পনা করছে বলে জনমনে সন্দেহ প্রবল হয়েছে। চট্টগ্রাম হচ্ছে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রাণকেন্দ্র এবং ভূ-রাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ অঞ্চল ভারতকে তুলে দেওয়ার চেষ্টা মানে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করা।
সুতরাং, খাগড়াছড়ি উত্তেজনা কোনো হঠাৎ জন্ম নেওয়া ঘটনা নয়। এটি আসলে পরাজিত আওয়ামী লীগের ব্যর্থ রাজনীতির অংশ, শেখ হাসিনার বিদেশ থেকে ষড়যন্ত্রমূলক তৎপরতা এবং ভারতের সঙ্গে আঁতাতের বহিঃপ্রকাশ। বাংলাদেশের জনগণকে এই পরিস্থিতি সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে, নইলে দেশ এক গভীর বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দেওয়া হবে।
ভারতের গভীর ষড়যন্ত্র রুখতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কিছু বিষয়ে মনোযোগী হওয়া। সম্প্রতি খাগড়াছড়িতে সৃষ্ট উত্তেজনা কেবল একটি আঞ্চলিক সমস্যা নয়, বরং এর পেছনে ভারতের দীর্ঘমেয়াদি ভূ-রাজনৈতিক কৌশল এবং বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করার গভীর ষড়যন্ত্র রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। সীমান্তবর্তী এলাকা হওয়ায় খাগড়াছড়ি বরাবরই ভারতীয় গোয়েন্দা কর্মকাণ্ড, বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীর প্রভাব ও ভূ-সম্পদ দখলের ষড়যন্ত্রে আলোচনায় থাকে। এই পরিস্থিতিতে ড. ইউনুসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সামনে চ্যালেঞ্জ হলো—দেশের অভ্যন্তরে স্থিতিশীলতা রক্ষা করা এবং বহিরাগত ষড়যন্ত্রকে কার্যকরভাবে মোকাবিলা করা।
1. গোয়েন্দা কার্যক্রম শক্তিশালী করা সীমান্তবর্তী এলাকায় ভারতের সঙ্গে যুক্ত সন্দেহজনক গোষ্ঠীগুলোর ওপর নজরদারি বাড়াতে হবে। স্থানীয় প্রশাসন, সেনা ও গোয়েন্দা সংস্থার সমন্বয়ে বিশেষ টাস্কফোর্স গঠন প্রয়োজন।
2. সীমান্ত নিরাপত্তা জোরদার করা বিজিবি, সেনা ও পুলিশের যৌথ টহল বৃদ্ধি করতে হবে। অবৈধ অনুপ্রবেশ, চোরাচালান ও অস্ত্র পাচার কঠোরভাবে দমন করতে হবে।
3. স্থানীয় জনগণের আস্থা অর্জন খাগড়াছড়ি ও পার্বত্য এলাকার মানুষের দীর্ঘদিনের জমি ও নাগরিক অধিকার সমস্যা সমাধানে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। উন্নয়ন প্রকল্প, শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তিকে দুর্বল করতে হবে।
4. কূটনৈতিক তৎপরতা ভারতের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় সীমান্ত স্থিতিশীলতা ও পারস্পরিক আস্থার বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে তুলতে হবে। আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে কূটনৈতিক অবস্থান জোরালো করতে হবে।
5. তথ্যযুদ্ধ মোকাবিলায় ভারতের পক্ষে পরিচালিত বিভ্রান্তিমূলক প্রচারণা প্রতিহত করতে রাষ্ট্রীয় ও স্বতন্ত্র গণমাধ্যমকে ব্যবহার করতে হবে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভুয়া প্রচারণা ঠেকাতে সাইবার নিরাপত্তা জোরদার করতে হবে।
6. জাতীয় ঐক্য গঠন রাজনৈতিক বিভাজন কমিয়ে সর্বস্তরের রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজ ও গণমাধ্যমকে সাথে নিয়ে জাতীয় নিরাপত্তা ইস্যুতে ঐক্যবদ্ধ অবস্থান নিতে হবে।
খাগড়াছড়ির উত্তেজনা নিছক স্থানীয় সমস্যা নয়; এটি ভারতের দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব বিস্তারের অংশ হতে পারে। তাই ইউনুস সরকারের করণীয় হলো—সীমান্তে শক্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা, জনগণের আস্থা অর্জন, কূটনৈতিক চাপ, এবং সর্বোপরি জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলা। এসব উদ্যোগই বাংলাদেশকে বহিঃশত্রুর ষড়যন্ত্র থেকে রক্ষা করবে এবং অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা বজায় রাখবে।
বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চল একটি সংবেদনশীল ভূরাজনৈতিক এলাকা। ভৌগোলিক অবস্থান, নৃতাত্ত্বিক বৈচিত্র্য এবং ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটের কারণে এ অঞ্চলের মানুষ বহু সময়ে বহিঃশক্তির কূটচালে জড়িয়ে পড়ে। বিশেষ করে ভারতের দীর্ঘদিনের কৌশলগত পরিকল্পনার কারণে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিভ্রান্তি ও প্রভাব বিস্তার একটি বড় বাস্তবতা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
প্রথমত, জাতিগত বৈচিত্র্য পার্বত্য অঞ্চলের প্রধান বৈশিষ্ট্য। সেখানে চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, ম্রোসহ বহু ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী বাস করে। তাদের ভাষা, সংস্কৃতি ও আচার-অনুষ্ঠান মূলধারার বাঙালি সংস্কৃতির সাথে কিছুটা ভিন্ন হওয়ায় ভারত সহজেই তাদের মধ্যে ‘পরিচয়ের সংকট’ উসকে দেয়। এই সংকটকে কাজে লাগিয়ে ভারত নিজস্ব স্বার্থে বিভাজনমূলক রাজনীতি পরিচালনা করে।
দ্বিতীয়ত, অর্থনৈতিক বঞ্চনা ও অবকাঠামোগত পশ্চাৎপদতা ভারতকে ফাঁদ পাতার সুযোগ দেয়। পার্বত্য অঞ্চলে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান ও যোগাযোগ ব্যবস্থার দুর্বলতা মানুষকে হতাশ ও ক্ষুব্ধ করে তোলে। ভারত এই অসন্তোষকে কাজে লাগিয়ে নানা এনজিও, সাংস্কৃতিক কার্যক্রম কিংবা গোপন রাজনৈতিক সংগঠনের মাধ্যমে প্রভাব বিস্তার করে। ফলে অনেকে উন্নয়নের লোভে ভারতের মিথ্যা প্রতিশ্রুতির ফাঁদে আটকে যায়।
তৃতীয়ত, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ভারতের জন্য বড় হাতিয়ার। পাহাড়ি রাজনীতি সবসময় দুই ভাগে বিভক্ত ছিল—এক অংশ শান্তি চায়, আরেক অংশ সশস্ত্র আন্দোলনকে সমর্থন করে। ভারত কৌশলে অস্ত্র ও অর্থ দিয়ে বিদ্রোহী গোষ্ঠীকে শক্তিশালী করেছে, যাতে বাংলাদেশ সরকারকে চাপে রাখা যায়। এতে সাধারণ মানুষ বিভ্রান্ত হয়ে ভারতের প্ররোচনায় গোপনে সমর্থন দেয়।
চতুর্থত, ভৌগোলিক অবস্থানও ভারতের কৌশলকে সহজ করেছে। পার্বত্য অঞ্চল ভারতের ত্রিপুরা, মিজোরাম ও অরুণাচল প্রদেশের সাথে সীমানা ভাগ করেছে। সীমান্তরেখা পাহাড়ি ও দুর্গম হওয়ায় অবাধ যাতায়াত ঘটে। ভারত এই সীমান্ত ব্যবহার করে প্রচুর প্রচার, প্রলোভন ও সরাসরি যোগাযোগ বজায় রাখে, যা স্থানীয়দের প্রভাবিত করে।
সর্বশেষে, বলা যায়—ভারতের দীর্ঘমেয়াদী স্বার্থ হলো বাংলাদেশকে দুর্বল রাখা এবং চট্টগ্রাম বন্দরসহ কৌশলগত এলাকায় প্রভাব বিস্তার করা। তাই তারা পার্বত্য অঞ্চলের মানুষকে বারবার নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করার চেষ্টা করে। আর পাহাড়িদের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংকট ভারতের ফাঁদে পা দেওয়ার সবচেয়ে বড় কারণ হয়ে দাঁড়ায়।