*বাংলাদেশ হুমকি নয় নিরাপত্তায়, বরং ভারতের কাছে আত্মনির্ভরতা ও স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি*
বাংলাদেশ ভারতের জন্য সরাসরি কোনো নিরাপত্তা হুমকি নয়। বরং দুই দেশের সীমান্ত সহযোগিতা, গোয়েন্দা তথ্য বিনিময়, এবং চুক্তি প্রমাণ করে যে নিরাপত্তার দিক থেকে বাংলাদেশ ভারতকে সহায়তা করে আসছে।
কিন্তু সমস্যা হচ্ছে আধিপত্যবাদী মানসিকতা থেকে ভারত চায় প্রতিবেশীরা তাদের কৌশলগত প্রভাববলয়ের ভেতরে থাকুক।
বাংলাদেশ স্বতন্ত্র কূটনীতি বা চীনের মতো অন্য শক্তির সাথে সম্পর্ক জোরদার করলে, ভারত সেটিকে হুমকি হিসেবে দেখে।
সীমান্ত, পানি, বাণিজ্য ও রাজনীতিতে ভারত প্রভাব বিস্তার করতে চাইছে—এখানেই মূল দ্বন্দ্ব।
ফলে “নিরাপত্তা উদ্বেগ” আসলে ভারতের একধরনের ভূ-রাজনৈতিক কৌশল, যাতে প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোকে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়।
অর্থাৎ বাংলাদেশের হুমকি নয় নিরাপত্তা, বরং ভারতের কাছে হুমকি হলো বাংলাদেশের আত্মনির্ভরতা ও স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি।
নিরাপত্তার জন্য বাংলাদেশসহ ৫ দেশকে হুমকি ভাবছে ভারত। সোমবার (১৫ সেপ্টেম্বর) কলকাতায় সেনাবাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ড সদর দপ্তরে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ৩ দিনব্যাপী এ দ্বিবার্ষিক সম্মেলন উদ্বোধন করেন। এ বছর এর মূল প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ‘ইয়ার অব রিফর্মস-ট্রান্সফরমিং ফর দ্য ফিউচার’। ভারতের সর্বোচ্চ পর্যায়ের এ ফোরামে শীর্ষ রাজনৈতিক ও সামরিক নেতৃত্ব একসঙ্গে বসে প্রতিরক্ষা প্রস্তুতির রূপরেখা তৈরি করে।
ভুটান ও মিয়ানমার ছাড়া বাংলাদেশ, চীনসহ বাকি পাঁচ প্রতিবেশী দেশকে নিরাপত্তার জন্য হুমকি মনে করছে ভারত। পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতায় চলমান ‘কম্বাইন্ড কমান্ডারস কনফারেন্সে’ ভারতের নিরাপত্তা মহল জানিয়েছে, বাংলাদেশের তথাকথিত ‘উগ্রপন্থি তৎপরতার উত্থান’, পাকিস্তানের ‘জঙ্গি অর্থায়ন’, চীনের সঙ্গে ‘সীমান্ত অচলাবস্থা’ এবং নেপালের ‘রাজনৈতিক অস্থিরতাকে’ ভারতের বড় সংকট হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে সর্বোপরি আধিপত্যবাদী কৌশল দেখা গেছে। ঐতিহাসিক দৃষ্টিতে ও সাম্প্রতিক সময়ে এ ধরনের নানা উদাহরণ রয়েছে।
★বাংলাদেশে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ভারতীয় কোম্পানিগুলো (আদানি গ্রুপ ইত্যাদি) বিশেষ করে বিদ্যুৎ খাতে প্রভাব বিস্তার করছে। এর মাধ্যমে অর্থনৈতিক নির্ভরতা তৈরি হচ্ছে।
★বাংলাদেশের সঙ্গে পানি বণ্টন ইস্যু তিস্তা নদীর পানি বণ্টন চুক্তি বছরের পর বছর ঝুলে আছে। ভারত তার অভ্যন্তরীণ রাজনীতির (পশ্চিমবঙ্গের আপত্তি) কারণ দেখিয়ে বাংলাদেশকে চাপের মুখে রেখেছে।
★বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সময় (১৯৭১-৭৫) স্বাধীনতা সংগ্রামে ভারত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখলেও পরে তৎকালীন সরকারের উপর রাজনৈতিক ও সামরিক প্রভাব বিস্তার করতে চেষ্টা করে।
★১৯৭৫ সালে ইন্দিরা গান্ধীর শাসনামলে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করে।
★শ্রীলঙ্কা ও এলটিটিই সংকট (১৯৮০-৯০ দশক) ভারত প্রথমে তামিল বিদ্রোহীদের (LTTE) পরোক্ষ সহায়তা করে। পরে শ্রীলঙ্কা সরকারের অনুরোধে ১৯৮৭ সালে শান্তিরক্ষী বাহিনী (IPKF) পাঠায়। এতে ভারতের দ্বিমুখী ভূমিকা ও প্রভাব বিস্তারের কৌশল প্রকাশ পায়।
★ভুটানের পররাষ্ট্রনীতি নিয়ন্ত্রণ (১৯৪৯ চুক্তি) দীর্ঘ সময় ভারতের পররাষ্ট্র নীতি অনুযায়ী চলতে বাধ্য ছিল। যদিও ২০০৭ সালে চুক্তি শিথিল করা হয়, তবে ভারতীয় প্রভাব এখনও প্রবল।
★নেপালের অবরোধ (১৯৮৯ ও ২০১৫) ভারত নেপালের ওপর একাধিকবার সীমান্ত অবরোধ আরোপ করেছে। ১৯৮৯ সালে রাজতন্ত্রবিরোধী আন্দোলনের সময় ও ২০১৫ সালে সংবিধান প্রণয়নের পর অবরোধ করে নেপালকে চাপের মুখে ফেলে।
★চীনবিরোধী কৌশলে ভারত চীনকে মোকাবিলায় বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কা ও মিয়ানমারকে তার নিরাপত্তা বলয়ে রাখতে চায়। এজন্য অবকাঠামো, সামরিক সহযোগিতা ও অর্থনৈতিক চাপ ব্যবহার করছে।
★শ্রীলঙ্কার হাম্বানটোট বন্দরের চীনের উপস্থিতি মোকাবিলায় ভারতও তাদের বন্দর, জ্বালানি ও যোগাযোগ খাতে বিশেষ প্রভাব বিস্তার করছে।
★নেপালের রাজনৈতিক প্রভাব সংবিধান প্রণয়নে ভারতের প্রকাশ্য অসন্তোষ ও অবরোধ (২০১৫) ছিল একধরনের আধিপত্যবাদী কৌশল।
★চীন-ভুটান সীমান্তে ২০১৭ সালে (ডোকলাম) ভারত সরাসরি সেনা পাঠিয়ে ভুটানকে চাপের মধ্যে ফেলে চীনের সাথে মুখোমুখি হয়।
সারকথা ভারতের এই কৌশলকে“বিগ ব্রাদার সিন্ড্রোম” বলা যায়।
স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও অভ্যন্তরীণ সিদ্ধান্তগুলোতে চাপ প্রয়োগ করে বা সুবিধা আদায় করে ভারত প্রায়শই প্রতিবেশীদের কাছে আধিপত্যবাদী শক্তি হিসেবে ধরা দেয়। বাংলাদেশ ভারতের নিরাপত্তার জন্য কোনো সরাসরি হুমকি নয়। বরং ভৌগোলিক, ঐতিহাসিক এবং সামাজিক বাস্তবতা মিলিয়ে বাংলাদেশ ভারতের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত অংশীদার।
★বাংলাদেশ ভারতের পূর্বাঞ্চলকে মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে সংযুক্ত রাখার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভারত উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর নিরাপত্তা ও বাণিজ্যের জন্য বাংলাদেশকে অপরিহার্য মনে করে।
★অর্থনৈতিক ভাবে ভারতকে বাণিজ্য, বিদ্যুৎ, পরিবহনসহ বহু খাতে বাংলাদেশ সহযোগিতা করছে। ভারত বাংলাদেশের অন্যতম বড় রপ্তানি বাজার এবং বাংলাদেশ ভারতের একটি বড় বাণিজ্য অংশীদার।
★বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরে ভারতের বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোকে আশ্রয় না দেওয়ার নীতি নিয়েছে। উভয় দেশ সন্ত্রাস দমন, সীমান্ত নিরাপত্তা, মাদক ও মানবপাচার প্রতিরোধে নিরলস সহযোগিতা করেছে।
আঞ্চলিক স্থিতিশীলতায় বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নীতি অনুসরণ করে। ভারতের জন্য প্রকৃত নিরাপত্তা হুমকি আসে প্রধানত চীন ও পাকিস্তানের কাছ থেকে, বাংলাদেশ থেকে নয়।