নড়াইলে বিশ্বখ্যাত চিত্রশিল্পী এস এম সুলতানের ১০১তম জন্মবার্ষিকী উদযাপন
বাংলাদেশসহ বিশ্ব শিল্পাঙ্গনের অনন্য প্রতিভা এস এম সুলতানের ১০১তম জন্মবার্ষিকী নড়াইলে নানা আয়োজনে পালিত হয়েছে। রোববার (১০ আগস্ট) সকালে নড়াইলের মাছিমদিয়া গ্রামে অবস্থিত তাঁর সমাধিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন, দোয়া মাহফিল ও কোরআনখানির মধ্য দিয়ে দিনব্যাপী কর্মসূচির সূচনা হয়।
এদিন জেলা প্রশাসন, এস এম সুলতান ফাউন্ডেশন, নড়াইল প্রেসক্লাব, জেলা শিল্পকলা একাডেমি, সুলতান শিশু চারু ও কারুকলা ফাউন্ডেশন, সুলতান স্মৃতি সংগ্রহশালা, লাল বাউল সম্প্রদায়, চিত্রা থিয়েটারসহ বিভিন্ন সংগঠন শিল্পীর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে। জেলা প্রশাসন ও সুলতান ফাউন্ডেশন যৌথভাবে অনুষ্ঠানটির আয়োজন করে।
প্রধান অতিথি জেলা প্রশাসক ও সুলতান ফাউন্ডেশনের সভাপতি শারমিন আক্তার জাহান বলেন— “এস এম সুলতান কেবল নড়াইল বা বাংলাদেশের নয়, বরং তিনি বিশ্ব শিল্পভুবনের উজ্জ্বল নক্ষত্র। তাঁর চিত্রকর্মে মাটির গন্ধ, কৃষকের সংগ্রাম এবং গ্রামীণ জীবনের শক্তি ফুটে ওঠে। নতুন প্রজন্মের কাছে তাঁর সৃজনচেতনা পৌঁছে দেওয়া আমাদের দায়িত্ব।”
অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) লিংকন বিশ্বাস, স্থানীয় সরকার বিভাগের উপপরিচালক জুলিয়া সুকাইনা, অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ আরাফাত হোসেন, সুলতান ফাউন্ডেশনের সদস্য সচিব অ্যাডভোকেট ইকবাল হোসেন সিকদার, নড়াইল প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুর রশিদ লাবলু, সিনিয়র সহ-সভাপতি আজিজুল ইসলাম, সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট সিদ্দিকীসহ স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ।
শিল্পীর জীবন ও শিল্পভাবনা
১৯২৩ সালে জন্ম নেওয়া এস এম সুলতানের শৈশবের আনুষ্ঠানিক শিক্ষাজীবন দীর্ঘ হয়নি, তবে শিল্পের প্রতি অগাধ অনুরাগ তাঁকে নিয়ে যায় ঢাকা ও কলকাতায়। ১৯৪৪ সালে কলকাতা গভর্নমেন্ট আর্ট স্কুলে ভর্তি হলেও স্নাতক শেষ না করেই তিনি সৃজনশীল স্বাধীনতার পথে হাঁটেন। ভারত, পাকিস্তান, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে তাঁর চিত্র প্রদর্শনী আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি এনে দেয়।
তাঁর ক্যানভাসে গ্রামীণ কৃষিজীবন—সুঠাম দেহের কৃষক, সোনালী ধানক্ষেত, গবাদি পশুর দৃশ্য—শক্তি ও মর্যাদার প্রতীক হয়ে ফুটে উঠেছে। সমালোচকদের মতে, তাঁর শিল্প শুধু নান্দনিক চিত্রায়ন নয়, বরং সামাজিক-রাজনৈতিক বক্তব্যেরও বাহক।
সম্মাননা ও অবদান
চিত্রকলায় অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে তিনি ১৯৮২ সালে একুশে পদক, ১৯৯৩ সালে স্বাধীনতা পদক, ১৯৮৪ সালে রেসিডেন্ট আর্টিস্ট স্বীকৃতি এবং ১৯৮৬ সালে বাংলাদেশ চারুশিল্পী সংসদ সম্মাননা লাভ করেন। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ‘ম্যান অব দ্য ইয়ার’, নিউইয়র্ক বায়োগ্রাফিক্যাল সেন্টার ‘ম্যান অব অ্যাচিভমেন্ট’ এবং এশিয়া উইক পত্রিকা ‘ম্যান অব এশিয়া’ উপাধিতে ভূষিত করে।
জীবনের শেষভাগে তিনি নড়াইলে ফিরে এসে শিশুদের জন্য গড়ে তোলেন ‘শিশু স্বর্গ’ ও ‘সুলতান সংগ্রহশালা’, যা এখনো শিল্পপ্রেমীদের কাছে অন্যতম আকর্ষণ।
১৯৯৪ সালের ১০ অক্টোবর তিনি যশোর সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। নড়াইলের কুড়িগ্রামে অবস্থিত সুলতান সংগ্রহশালা প্রাঙ্গণে তাঁর সমাধি রয়েছে।
জন্মবার্ষিকীর কর্মসূচি
শিল্পীর জন্মদিন উপলক্ষে এদিন কোরআন খতম, কবরে পুষ্পস্তবক অর্পণ, শিশুদের চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা ও আলোচনা সভাসহ বিভিন্ন আয়োজন হয়। স্থানীয় সাংস্কৃতিক সংগঠন, স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী, শিল্পপ্রেমী ও দূরদূরান্ত থেকে আগত দর্শনার্থীরা অংশ নেন।
নড়াইলবাসীর গর্ব এস এম সুলতান শুধু একজন চিত্রশিল্পী নন—তিনি বাংলার মাটি, মানুষ ও শিল্পচেতনার এক চিরন্তন প্রতীক।